Sunday, June 5, 2011

স্বর্গ

'দুইটা টাকা দেন গো স্যার', হঠাত্ তন্দ্রাটা চটে যায় মামুনের। জ্যামে প্রতিদিনই আটকে থেকে বাসে বসে বসে ক্লান্তিতে তন্দ্রা মতো এসে যায়। আজ যেন সেটা একটু বেশিই।

'দুইটা টাকা দেন গো স্যার, লেবুগুলা নিয়া যান, মিষ্টি লেবু'

মামুন ছোট মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। বয়স চার হবে হয়তো। উস্কোখুস্কো চুল, মলিন কালশিটে পড়া গাল, তারও মুখে ক্লান্তির অভিব্যক্তি। সারাদিন রোদের নিচে ছুটোছুটি করে লেবু বিক্রি করে। এই বয়সে তার সারাদিন ছুটোছুটি করে খেলা করার কথা ছিলো, মাতিয়ে রাখার কথা ছিলো চারপাশ। কিন্তু ভাগ্য তার এই ক্ষুদ্র জীবনটাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে।

মামুনের চোখের ভাব ছোট মেয়েটা বুঝতে পারে না। তার সময় মামুনের সময় থেকে অনেক মূল্যবান এই মুহূর্তে। সে চলে যেতে উদ্যত হয়।

'এই দাড়া, কয়েকটা লেবু দে', মামুন ১০ টাকার একটা নোট বের করে আনে পকেট থেকে। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছোট মেয়েটার চোখ। ক্লান্তিটা যেন উবে যায়। দ্রুত ভাংতি বের করতে উদ্যত হয় সে।

'না না রেখে দে পুরাটা, ভাংতি লাগবে না'

মেয়েটা মামুনের মুখের দিকে তাকায়। তারপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। চোখ দুটায় যেন কৃতজ্ঞতা ভরে উঠে। মামুন খেয়াল করে হাসিটা বেশ মিষ্টি। সে লেবুগুলো মামুনের হাতে দিয়ে নোটটা নিয়ে দৌড়ে চলে যায় দূরে রাস্তার পাশে। মামুন দেখতে পেল সেখানে একটা ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে শীর্ণকায় একজন মহিলা বসে লেবু ব্যাগে ভরছেন। উনি বোধহয় মেয়েটার মা, চেহারার আদল দেখে তাই মনে হলো। মেয়েটা ১০ টাকার নোটটা তার মাকে দিলো, হাত নেড়ে নেড়ে মাকে কিছু একটা বললো, কোন একটা খুশির ঘটনা যেন ঘটেছে, এই সামান্য টাকাগুলার জন্যই নিশ্চয়। তারপর মেয়েটা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করে একটা চুমু খেলো। একটু দোলালো, হাত নেড়ে নেড়ে মুখভঙ্গী করে কিছু একটা বললো। বাচ্চাটাও খিলখিল করে হেসে ছোট ছোটা হাতপাগুলা নেড়ে তার বোনকে কিছু একটা বলতে চাইলো। নিজের ভাষায় বোনকে ভালোবাসা দিলো হয়তো।

রাস্তার ধারে এই দৃশ্যে মামুনের চোখে একটু পানি এসে গেলো। তার দিনটা বিভিন্ন কারনে খুবই খারাপ গিয়েছে। তার বিপর্যস্ত ক্লান্ত মনটা এই ছোটা দুইটা শিশুর কাজকর্ম দেখে হঠাত্ ভালো হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রাইলো তাদের দিকে। শহুরে কংকালসার মানুষেরা প্রকৃতিকে হয়তো ঝেটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছে কিন্তু প্রকৃতি তার ভালোবাসার ছোয়া শহরের আনাচে কানাচে ছিটিয়ে রেখেছেই। বাস চলা শুরু করলো, দ্রুত থেকে দ্রুততর, জ্যাম ছুটে গেছে। মামুনের সামনে থেকে দৃশ্যটা সরে যেতে থাকলো, না চাইলেও মনে জমে আসতে শুরু করলো সারাদিনের জমে থাকা চিন্তুা, ভবিষ্যতের চিন্তা। চারিদিকে অর্থহীন গতিময়তা তার মনকে আরও অবশ করে দেয়। কিছুক্ষণ পর হয়তো ভুলে যাবে ওই দৃশ্যের কথা কিন্তু সে জানে রাস্তার পাশের ছোট্ট স্বর্গটা থেকেই যাবে সবার জন্য, একটু চোখ মেলে খুজে নিতে হবে শুধু।

No comments:

Post a Comment