Thursday, July 7, 2011

সাজু

কাক ডাকা ভোর। আলো পুরোপুরি ফোঁটে নাই এখনও। একটা দু'টা রিকসা চলছে রাস্তায়। মাঝে মধ্যে হুস্ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। টুকরি নিয়ে সাজু দ্রুত পায়ে হেটে চলেছে সাজু। গন্তব্য কারওয়ান বাজার। কঠিন একটি দিনের শুরু, প্রতিদিনের মতো ক্রেতাদের বাজার সদাই টুকরিতে বহন করেই তার দিনটা যাবে। কিন্তু তার মতো টুকরিওয়ালা মেলা। ক্রেতা পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। কাজ শেষে বঞ্চনাতো আছেই। সাজুর মনে পড়ে যায় ওই দিনের কথা। ভারি টুকরি নিয়ে তাকে যেতে হয়েছিলো বেশ দূর, মগবাজারে ডাক্তার গলি। লোকটা পথে ক্ষণে ক্ষণে ধমকাচ্ছিলো তাকে জোরে হাঁটার জন্য। তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলো সাজু। টুকরির সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো রাস্তায়। তখন লোকটা সাজুর চুল ধরে কি মারটাই না মারলো। ঠোঁট কেটে রক্ত বেড়িয়েছিলো, কিন্তু কিছুই বলে নাই, শুধু ক্ষীণ স্বরে মা'কে ডেকেছিলো কয়েকবার। মা কাছে থাকলে বলা যেত কষ্টের কথা।

কিশোরগঞ্জের এক অজপাড়াগায়ের ছেলে সাজু। শৈশবেই বাবা তার মারা গেলো কলেরাতে ভুগে। মা'র কতো সাধ ছিলো ছেলেকে লিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করবেন! অভাবের তাড়নায় মায়ের সাধটা অপূর্ণই রয়ে গেল, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ক্ষান্ত দিয়ে দূরসম্পর্কের চাচা সুরুজ মিয়ার হাত ধরে চলে আসলো ঢাকা শহর। । ট্রেন থেকে নেমে সুরুজ মিয়া তাকে নিয়ে এসেছিলো কারওয়ান বাজার। বলেছিলো 'বুঝলা ভাতিজা, এইডা হইলো ঢাকা শহর, এইহানে টেকা উড়ে কিন্তু কেউ কারো না, তুই একটু খাড়া, আমি চা খইয়া আসি'। সুরুজ মিয়া আর আসলো না। সাজুর জীর্ণ পুটলিতে মায়ের দেয়া কয়েকটা টাকা আর শুকনা চিড়াই সম্বল। বারবার মায়ের কথা মনে পড়েছিলো। বিদায়ের আগে মা বলেছিলো, 'ভয় পাইসনা বাপজান আমার, কারও ক্ষতি করিস না, ভিক্কা করবি না, ভয় পাইলে আল্লারে ডাকিস। তোরে আল্লা দেখবো।' মায়ের কথা চিন্তা করে দুচোখ ভিজে উঠেছিলো।

ওই রাতটা কারওয়ান বাজারে কোনমতে একটা আড়তের পাশে শুয়ে কাটিয়ে দেয় সাজু। তবে সুরুজ মিয়ার কথা পুরা সত্য না। আড়তের মালিক মোসলেম ব্যপারী সাজুকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে বলেছিলো 'ওই ছেড়া এইখানে ঘুমাইলে কেউ তোরে খাওন দিবো না, নিজে কইরা খাইতে হইবো, আমারেও করতে হয়'। সাজুর মলিন চেহারা দেখে তার ভেতর বোধয় করুনা হয়েছিলো। 'ছেড়া শুন, এই টুকরিডা লইয়া যা, সারাদিন মাল টানবি, যখন একটা টুকরি নিজে কিনা লইতে পারবি তহন আমারডা আমারে দিয়া যাস মনে কইরা'।

সেই থেকে টুকরিটাই হলো তার জীবিকা। প্রথমদিকে সে রাতে থাকতো ফুটপাতে। তারপর থেকে সে থাকে মগবাজারে একটা পুরানো গ্যারেজে, সাথে বাস করে তার মতোই ছিন্নমূল কিছু মানুষ। কেউ মাটি কাটে ইট ভাঙ্গে, কেউ রিকসা চালায় আর কেউ তার মতো টুকরি বয়। ভিন্ন ভিন্ন পেশা কিন্তু ভাগ্যের কতো মিল! সাজুর টুকরি বইতে ভালো লাগে না কিন্তু তাকে কেউ অন্য কাজ দিতে চায় না। সাজু মনে মনে সবসয়ম ভাবে 'মা তুমি দেইখো আমি একটু বড় হইয়া লই তারপর বড় দেইখা একটা রিসকা কিনমু, অনেক টেকা হইবো, তোমারে শাড়ি কিনা দিমু, তহন আর কষ্ট হইবো না, তোমারে ঢাকায় নিয়া আসুম।'

সাজু পা চালায়। কারওয়ান বাজারটা এই ভোরবেলাতেই ক্রেতা বিক্রেতায় যেন উত্সবমুখর। শুক্রবার ছুটির দিন, ভিড় একটু বেশিই। টুকরি বইবার সুযোগ পেয়ে যায় সহজেই। আজকে দিনটা আল্লা ভালোই রাখছে। একে একে বেশ কয়েকটা ক্রেতা পেয়ে যায়। ব্যস্ত দিন কাটতে থাকে। একটু বিশ্রাম পেয়ে সাজু বসে গামছায় মুখ মোছে। 'ওই পোলা যাবি ওয়্যারলেস মোড়', ব্যস্ত হাতে তাকে ডাকছে একজন ক্রতা। 'হ যামু' বলে উঠে পড়ে সে। হঠাৎই তার চোখ পড়ে একটু দূরে, একজন লোক কিছু একটা কিনতে গিয়ে মানিব্যাগটা অসাবধানে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সাজু এগিয়ে যায়, মাটি থেকে ওটা উঠায়। ততক্ষনে লোকটা ঘুরে তাকিয়েছে 'ওই শালা তুই আমার মানিব্যাগ লাইছোস' বলেই কিছু বলার আগে সাজুর গালে সজোরে চড় কষায়। সাজু দাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। পড়ে যায় মাটিতে। হাতে তার মানিব্যাগটা এখনও ধরা। 'কি হইছে, কি হইছে' 'ধর ধর পকেটমার' বলে আশেপাশে থেকে মানুষজন ছুটে আসে। 'আরে এই শালা আমার মানিব্যাগ লইছে' বলেই লোকটা সাজুর পিঠে একটা লাথি মারে। একে একে চারপাশ থেকে আরও কয়েকটা বর্বর পা সাজুর ছোট শরীরটাকে পিষ্ট করে দেয়। 'মার শালারে, দেখছেন এই পোলা ছোট থেকেই কিভাবে পকেটমার হইছে' ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠে। সাথে কয়েকজন তাতে সাঁয় দেয়। অবোধ মানুষেরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে সমাজের মিথ্যা বিষ বের করতে থাকে।

কতক্ষণ এভাবে পড়েছিলো সাজুর মনে নাই। সাজুর অচেতন দেহটাকে ঘিরে বর্বরদের উল্লাস একসময় থেমে গিয়েছিলো। চোখ খুলে সাজু দেখলো সে হাসপাতালে, পাশে মোসলেম ব্যপারী। 'তুই চুরি করলি কেনরে ছেড়া, আমারে কইতি, আমি তোরে কাম দিতাম'। সাজু আধবোজা চোখ মেলে তার দিকে তাকায়। 'আমি চোর না সাব, ওনারে ওনার টেকার ব্যাগ দিতে গেছিলাম, ওইডা পাইড়া গেছিলো' সাজু কাঁদতে থাকে 'মায়ে আমারে কইছে মাইনষের উপকার করতে, কারও ক্ষতি করতে না'। মোসলেম ব্যপারী বুঝে, তার হাত ধরে বলে 'তুই ঘুমা'। সাজু দু'চোখ বন্ধ করে। তার মনে পড়ে মায়ের কথা। 'মা তুমি কই মা, আমি ব্যথা সইয্য করতে পারি নাগো মা, তুমি একটু দেইখা যাও মা, আমারে একটু ধইরা আদর দিয়া যাও'। সাজুর মনের কথাগুলা ব্যথাগুলা চোখের জলে নিরবে ঝরে পড়তে থাকে। সন্ধ্যার আগে আগে সাজু মারা গেল।

দমকা বাতাসে জানলার ধারে কেরোসিন কুপিটা হঠাৎ নিভে গেল। অজানা আতংকে সাজুর মা'র বুকটা ধ্বক করে উঠে। বাইরে বৃষ্টি। দূরে মসজিদে আজান দিতেছে। মাগরিবের ওয়াক্ত। 'আল্লা তুমি আমার পোলাডারে ভালো রইখো, কতদিন ওরে দেখি না, ওরে একটু আদর করতে পারি না, ও আইলে আলু দিয়া মুরগির ঝোল রাইন্দা খাওয়ামু, খুব পছন্দ করে সে' মায়ের চোখে পানি জমে উঠে। ছেলের বিরহে মা'র বুকটা ফেটে যেতে চায়। ধীর হাতে কুপিটা আবার জ্বালায়। নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। দূরে সন্ধ্যাতারাটা বার'কয়েক মিটিমিটি করে জ্বলে কেন যেন হঠাৎ নিভে যায়। আস্তে আস্তে বৃষ্টির ধাঁচটা কমে যায়। কিন্তু মায়ের চোখের অশ্রুধারা বয়েই যেতে থাকে।